ডেস্ক নিউজ: ১৫ রমজান শুক্রবার পৃথিবীতে কি ঘটতে যাচ্ছে? বিশেষ করে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে এবারের রমজান শুক্রবার দিয়ে শুরু হওয়ায় এ বিভ্রান্তি আরও বেশি ছড়াচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে ১৫ রমজান, কেয়ামত হয়ে যাবে? বেশ কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষের মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় বোধগম্য নয় যে, সৌদি আরবসহ অনেক দেশে শুক্রবার রোজা শুরু হয়নি এবং ১৫ রমজানও শুক্রবার নয়। তবে কি তারা এর ব্যতিক্রম? তারা পৃথিবীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাবে? এবিষয়ে বাইতুন নূর জামে মসজিদের খতিব ও প্রধান ইমাম মুফতী শেখ মো. শওকত আলী সুহাইল নিউজ বুলেটিনকে বলেন, কেয়ামতের অসংখ্য ছোট আলামত পৃথিবীতে ঘটে গেছে। বড় যে আলামতগুলো সেগুলো ঘটা এখনও বাকি রয়েছে। যেমন ইমাম মাহদি (আ.) এর আগমন, হযরত ঈসা (আ.) এর অবতরণ, ইয়াজুজ মাজুস-দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ, এসমস্ত বিষয়গুলো যতক্ষণ সংগঠিত না হবে কেয়ামত হবে বলে হাদিসে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, পবিত্র কোরআনে সূরা বানী ইসরাইলে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানো না, সে বিষয়ে বর্ণনা করো না। সুতরং এ বিষয়টি যেহেতু আমাদের অকাট্য জ্ঞানে নেই এবং এই সম্পর্কীত যে হাদিসটি শোনা যাচ্ছে সেই হাদিসের দালিলিক বিশুদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এজন্য এধরণের গুঞ্জন থেকে সকলকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এদিকে হাদিসে রয়েছে, কেয়ামতের সবচেয়ে বড় আলামত হলো ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস হলো শেষ জমানায় প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদির আবির্ভাব সত্য। ইমাম মাহদি নবি-পরিবার থেকেই হবেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘মাহদি আহলে বাইতের ফাতেমি বংশ থেকেই হবেন।’ (আবু দাউদ ৪২৮৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যদি কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাত্র একদিনও অবশিষ্ট থাকে তবুও আল্লাহ তাআলা ওই দিনকে দীর্ঘ করবেন এবং আমার বংশের এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তার নাম আমার নামের সঙ্গে এবং তার পিতার নাম আমার পিতার নামের সঙ্গে মিলে যাবে।’ (আবু দাউদ ৪২৮২)
হজরত হোজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তার চেহারা হবে উজ্জ্বল তারকার ন্যায়।’ (কানজুল উম্মাল ৩৮৬৬৬)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইমাম মাহদি প্রশস্ত ললাট এবং লম্বা ও সরু নাকের অধিকারী হবে।’ (আবু দাউদ ৪২৮৫)
কেয়ামত বা পৃথিবী ধ্বংস পূর্ব মুহূর্তের সে সময়টিতে পৃথিবীর পরিস্থিতি হবে ভয়ংকর। হাদিসে পাকে এসেছে-হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সেই মহান সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই মানুষের ওপর এমন একটি জামানা আসবে যখন হত্যাকারী বুঝতে পারবে না কী কারণে হত্যা করেছে এবং নিহত ব্যক্তিও বুঝতে পারবে না কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুসলিম ২৯০৮)
ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের আলামতসংক্রান্ত একটি হাদিস এসেছে। কোনো এক জুমাবার হবে ১৫ রমজানে। সেদিন আকাশে বিকট আওয়াজ হবে। হাদিসটি ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো এক রমজানে আওয়াজ আসবে’। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের শুরুতে নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে?’ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় ৭০ হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে যাবে আর ৭০ হাজার বধির হয়ে যাবে।’বিজ্ঞ হাদিস বিশারদগণ হাদিসের এ বর্ণনাটিকে অত্যন্ত দুর্বল হিসেবে এবং অনেকে বাতিল ও বানোয়াট হাদিস বলে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখিত বর্ণনাটি সহিহ নয়। বরং এই হাদিসের শেষের দিকে আছে, সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সেজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহু আকবর বলবে। পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিবরিলের, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের। দীর্ঘ এ হাদিসটি বর্ণিত ঘটনার পরম্পরা অনুযায়ী, শব্দ আসবে রমজানে। ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে। আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জিলকদ মাসে। হাজি লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটবে জিলহজ মাসে। আর মুহররমের শুরুটা আমার উম্মতের জন্য বিপদ, শেষটা মুক্তি। সেদিন মুসলমান যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে।’ (আল মুজামুল কাবির লিত তবারানি ১৮/৩৩২/৮৫৩)
এই হাদিস সম্পর্কে শায়খ আলবানি (রহ) বলেন, হাদিসটি موضوع তথা বানোয়াট। ইবনুল জাওজি তার মাউজুআত তথা বানোয়াট হাদিস সংকলন গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। (৩/১৯১)
ইমাম জাহাবি বলেন, হাদিসটি বাতিল। (তারতিবুল মাউজুআত: ২৭৮)। হাইসামি বলেন, এই হাদিসের বর্ণনা সূত্রে আব্দুল ওহাব ইবনুজ জাহহাক নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে মুহাদ্দিসিনদের দৃষ্টিতে মাতরুক বা পরিত্যাজ্য। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ:৭/৩১৩)
ইমাম ইবনুল কাইয়িম বলেন,‘অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনার বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। সেগুলো সহিহ নয়।’ এর মধ্যে একটি হলো—‘অর্ধ রমজানের জুমার রাতে একটি আওয়াজ হবে। এতে ৭০ হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে..৭০ হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে..।’(আল মানারুল মুনিফ: ৯৬ পৃষ্ঠা)
১৫ রমজান মধ্য রাতে বিকট শব্দ সম্বলিত হাদিসটি সঠিক নয় মর্মে মুহাদ্দিসিনের কেরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এসব ভিত্তিহীন গুজব থেকে সাবধান থাকা জরুরি।